সরদার-জয়েনউদদীন-১ম-পর্ব
কামারহাট,  কৃতি ব্যক্তিবর্গ,  নাজিরগঞ্জ,  লেখক পরিচিতি,  সাহিত্য

সরদার জয়েনউদদীন (১ম পর্ব)

সরদার জয়েনউদদীন (১ম পর্ব)

 

বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে, ভাষা ও সংস্কৃতির ক্রান্তিকালে বাংলা সাহিত্যে সরদার জয়েনউদদীনের দীপ্র আবির্ভাব। কথাসাহিত্যের ভ‍ূবনে একটি উজ্জ্বল নাম সরদার জয়েনউদদীন।

সাংবাদিকতা এবং সাহিত্যের জগতে সরদার জয়েনউদদীন সর্বদা ছিলেন প্রগতির পক্ষে, মানবতার পক্ষে। একসময়, পঞ্চাশ-ষাটের দশকে, ঢাকার সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় অবশ্য উচ্চার্য নাম ছিল সরদার জয়েনউদদীন, কিন্তু পরিবর্তমান রুচি ও সমাজ স্রোতে এখন তিনি প্রায়-বিস্মৃত এক নাম। তবে যারা সৎ পাঠক, তাদের চেতনায় সরদার জয়েনউদদীন সর্বদা জেগে থাকবেন। কেননা তার সাহিত্যে আছে গণমানুষের মুক্তি-আকুতির কথা। তিনি ছিলেন একাধারে একজন ঔপন্যাসিক, গল্পকার ও সম্পাদক। তিনিই বাংলাদেশে বইমেলার প্রবর্তক। 

বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৭), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৭), অগ্রণী ব্যাংক পুরস্কার (১৯৮১), উত্তরা ব্যাংক পুরস্কার (১৯৮২), বাংলাদেশ লেখক সংঘ পুরস্কার (১৯৮৪)  এবং মরোনোত্তর একুশে পদক (১৯৯৪) এ ভূষিত হন।

জন্ম: কথাসাহিত্যিক সরদার জয়েনউদদীন ১৯১৮ সালে ১ মার্চ, পাবনা জেলার  সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের বড়খাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, তাঁর নানার বাড়িতে। পৈতৃক নিবাস একই ইউনিয়নের কামারহাট গ্রামে। তাঁর আসল নাম মুহম্মদ জয়েনউদদীন বিশ্বাস। 

পারিবারিক জীবন: পিতা জোতদার তাহের উদ্দিন বিশ্বাস, মাতা সখিনা খাতুন। তাহের উদ্দিন বিশ্বাসের চার পুত্র, তিন কন্যার মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ।

১৯৪৩ সালে সরদার জয়েনউদদীন আর রাবেয়া খাতুন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. রেবেকা বানু। বড় ছেলে প্রয়াত মেজর জেনারেল (অব.) জিয়া আহমেদ শেলী, প্রাক্তন বিটিআরসি চেয়ারম্যান এবং ছোট ছেলে জ্যোতি জয়েনউদদীন।

আরও পড়ুন  মাওলানা রইচ উদ্দিন

শিক্ষা জীবন: সরদার জয়েনউদ্দীনের শিক্ষা জীবন শুরু হয় আরবি শিক্ষা দিয়ে, স্থানীয় মাদ্রাসাতে। বছর খানেক পড়ার পর উদয়পুর মিডল ভার্নাকুলার স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৩২ সালে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি চার টাকা সরকারি বৃত্তি পান। যথাসময়ে উদয়পুর স্কুল থেকে পাশ করে কামারহাট থেকে মাইল পাঁচেক দূরে সাতবাড়িয়া হাই স্কুলে ভর্তি হন। এই সময় তিনি একটা জায়গীর খুঁজছিলেন যাতে রোজ এই পাঁচ মাইল আসা যাওয়ার কষ্ট থেকে বাঁচা যায় আর পরিবারের উপরও চাপ কমে। কিন্তু সাতবাড়িয়াতে জায়গীরের ব্যবস্থা না হওয়ায় কিছুদিন পর খলিলপুর হাই স্কুলের প্রখ্যাত হেডমাস্টার সুরে সেন তাঁকে জায়গীরের ব্যবস্থা করে খলিলপুর হাই স্কুলে ভর্তি করে দেন। ১৯৩৯ সালে খলিলপুর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে আইএ পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। প্রথাগত উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হলেও জীবিকার তাগিদে তিনি যে শিক্ষা লাভ করেছিলেন তা বর্ণাঢ্য বলা যেতে পারে।

কর্ম জীবন: কোলকাতায় ১০ টাকার একটা টিউশনি পেয়ে গেলেন, ফাঁকে ফাঁকে চাকরির সন্ধান চলছে। ১৯৪১ সালের শেষের দিকে চাকরি পেলেন তৎকালীন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। দেরাদুনে ট্রেনিং শেষে কাজে যোগ দিলেন ৯ মার্চ ১৯৪২-এ, পদ হাবিলদার ক্লার্ক। সেনাবাহিনীতে পাঁচ বছর চাকুরি করেন। ইতোমধ্যে ১৯৪৭-এ বৃটিশ রাজত্বের অবসানের পর ভারত ও পাকিস্তান, দুই রাষ্ট্রের অভ্যূদয় ঘটে। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে তিনিও সেনাবাহিনীর চাকুরী থেকে অব্যাহতি পান (৩১.১০.৪৭)। কর্তৃপক্ষ তাঁকে পুলিশে চাকুরী দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তাঁর পাওনা (এলাউন্স) বুঝে নিয়ে নিজের স্বাধীন দেশ পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। স্ত্রীকে গ্রামের বাড়ি কামারহাটে রেখে কাজের সন্ধানে এলেন রাজধানী শহর ঢাকায়।

আরও পড়ুন অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন

কলকাতা থেকে যা টাকা পয়সা এনেছিলেন তা দিয়ে জয়েনউদ্দীন শুরু করলেন শিশু শিক্ষার উপকরণ শ্লেটের ব্যবসা। তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে তাঁর ব্যবসা মার খেল। শুরু করলেন ঠিকাদারি, ক্যান্টনমেন্টে মালামাল সরবরাহের কাজ। ব্যবসায়িক চাতুর্য ও কূটকৌশলের অভাবে সে ব্যবসায়ও তিনি ব্যর্থ হন। চার বন্ধু কবি আব্দুল গনি হাজারী, প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান, হাবিবুর রহমান আর সরদার জয়েন উদদীন, ৩৬ র‍্যাঙ্কিন স্ট্রীটে একটি ঘরে থাকতেন, কাঁথা মাটিতে বিছিয়ে রাত্রীযাপন করতেন। এমনও দিন গেছে খাবারও জোটেনি, কয়েক আনার মুড়ি খেয়ে থেকেছেন। চার জনের জামা ছিল না, কেউ কেউ ঘরে থাকতেন, বাকিরা কাজের খোঁজে বেরোতেন। হঠাৎ করে ১৯৪৮ সালে দৈনিক পাকিস্তান অবজারভারের বিজ্ঞাপন বিভাগে সহকারী রূপে চাকুরি পেয়ে যান। এরপর ১৯৬০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ও প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন।

  • ১৯৪৯- চন্দ্রবিন্দু পত্রিকার মুদক ও ব্যবস্থাপক
  • ১৯৫০- মাসিক মুকতি পত্রিকার প্রকাশক, মুদ্রক ও ব্যবস্থাপক
  • ১৯৫১-৫৬ সেতারা ও শাহীন পাক্ষিক শিশু কিশোর পত্রিকার সম্পাদক
  • ১৯৫৬-৫৭ দি রিপাবলিক ত্রৈমাসিক ইংরেজি সাহিত্য পত্রিকার পরিচালক, প্রকাশক ও মুদ্রক
  • ১৯৫৮- দৈনিক ইত্তেফাক, বিজ্ঞাপন বিভাগের ম্যানেজার
  • ১৯৫৯- দৈনিক ইত্তেহাদ-ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার
  • ১৯৫৯- তিতাস প্রকাশনী, সাধারণ সম্পাদক

১৯৬০ সালে তিনি ইস্টার্ন ফেডারেল ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে ইন্সপেক্টর হিসেবে যোগ দেন। এতে সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসে। বাস্তবতার কারণে লেখালেখিটা কমে যায়। পরবর্তীতে সিকান্দার আবু জাফরের পরামর্শে ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমিতে প্রকাশনা ও বিক্রয় বিভাগে সহকারি হিসেবে যোগ দেন। এই পর্যায়ে সরদার জয়েনউদ্দীনের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী চাকুরিটি জুটে যায়। ইউনেস্কো ও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগতিায় ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল বুক সেন্টার। সরদার জয়েনউদ্দীন ৮ জুন ১৯৬৪ তে রিসার্চ অফিসার হিসেবে সেখানে নিয়োগ পান। সাংবাদিকতা, সম্পাদনা ও পুস্তুক প্রকাশনার সঞ্চিত অভিজ্ঞতা এখানে এসে তিনি কাজে লাগান। তাছাড়া এটি তাঁর মন মানসিকতার সঙ্গেও খুব সঙ্গতিপূর্ণ ছিল।

আরও পড়ুন  মোহাম্মদ আবিদ আলী

১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারি তিনি বুক সেন্টারের সহকারি পরিচালক হন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ন্যাশনাল বুক সেন্টারের নাম হয় “জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র” এবং তিনি তার প্রথম পরিচালক নিযুক্ত হন। পরিচালক হওয়ার পর তিনি ইউনেস্কোর শিশুসাহিত্য বিষয়ক উপকরণ সংগ্রহের কাজ করছিলেন। সেই সংগৃহীত উপকরণগুলো প্রদর্শনীর লক্ষে তিনি ১৯৬৫ সালে সেন্ট্রাল পাবলিক লাইব্রেরীতে (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার) শিশু গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। এটাই ছিল বাংলাদেশের গ্রন্থমেলার সূচনা। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জে আরেকটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে তিনি ভারত, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক, জার্মানীতে অনুষ্ঠিত বইমেলায় বাংলাদেশ স্টল রৌপ্যপদক লাভ করেন।

১৯৭২ সালকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ ঘোষণা করলে ডিসেম্বর মাসের ২০-২৫ তারিখ পর্যন্ত বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে তিনি গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমির বাইরে প্রগতি প্রকাশনী, মুক্তধারা ও বর্ণমিছিলের প্রকাশকরা স্টল বসিয়ে অনানুষ্ঠানিক বইমেলার স্থাপন করেন। পরে মুক্তধারা প্রকাশনীর চিত্তরঞ্জন সাহার নেতৃত্বে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত এই অনানুষ্ঠানিক বইমেলা চলতে থাকে। ১৯৮৪ সাল থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা আনুষ্ঠানিকভাবে আয়োজিত হয়ে আসছে। সেদিক থেকে সরদার জয়েনউদ্দীন বাংলাদেশে গ্রন্থমেলার প্রবর্তক।  সর্বশেষ তিনি বাংলাদেশ টেক্সট বুক বোর্ডের ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ পদে যোগ দেন। সেখানে থাকাকালীন তিনি ১৯৮০ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। 

মুক্তিযুদ্ধ: সরদার জয়েনউদ্দীন সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যোগ না দিলেও ঢাকায় থেকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নানাভাবে মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের সহযোগতিা করেছেন। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ঘোষিত (১৯৭০) “তমখা-এ-খেদমত ” পদক তিনি ঘৃণা ভরে প্রত্যাখান করেন।

অভিনয়: কবি আব্দুল গনি হাজারীর সঙ্গে কলকাতায় মহুয়া ফিল্ম নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ১৯৫৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম বাংলা ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’-এ তিনি ডাকাতের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।

আরও পড়ুন কথাসাহিত্যিক সরদার জয়েনউদ্দীন-
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৭ম পর্ব
 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

সরদার জয়েনউদদীন (১ম পর্ব)

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী আলতাব হোসেন, সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুন পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!