এম-আকবর-আলী
কৃতি ব্যক্তিবর্গ,  গবেষক,  গোপালপুর (ভায়না),  ভায়না,  মাধ্যমিক বিদ্যালয়,  লেখক পরিচিতি,  শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,  শিক্ষাবিদ,  সমাজসেবক,  সাহিত্য

এম. আকবর আলী

বাঙালি রেনেসাঁর অগ্রদূত এম. আকবর আলী। সুজানগর তথা পাবনার কৃতী সন্তানদের মধ্যে এম. আকবর আলী প্রথম সারির একজন। শিক্ষাবিদ, গবেষক, লেখক, চিন্তাবিদ, ইতিহাসানুরাগী, ঐতিহ্য সন্ধানী, দানশীল প্রভৃতি অভিধায় তাঁকে ভূষিত করা যায়। সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও সাতবাড়িয়া কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি।

জন্ম: লেখক এম. আকবর আলী ১৯১১ সালের ১ মার্চ, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত ভায়না ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামে জন্ম জন্মগ্রহণ করেন।

পারিবারিক জীবন: পিতা মুন্সি মিয়াজান মল্লিক ও মাতা বুলুজান নেছা। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে এম. আকবর আলী ছিলেন দ্বিতীয়। মোহাম্মদ আবিদ আলী, এম. আকবর আলী ও মোহাম্মদ আবদুল জব্বার এই তিন সহোদর যেন একই বৃত্তে তিনটি ফুল। এঁদের জন্মদায়িনী মা ব্রিটিশ আমলে ‘রত্নগর্ভা’ জননীর সম্মানে ভূষিত। পিতা মিয়াজান মল্লিক প্রথম জীবনে নৌকার মাঝি ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি স্বাধীনভাবে ছোট ছোট ব্যবসা শুরু করেন এবং এই ব্যবসার সীমিত আয় দিয়েই সংসার চালাতেন। তাঁর পিতা এবং মাতা উভয়েই ছিলেন বিদ্যানুরাগী।

আরও পড়ুন সুজানগর উপজেলার প্রথম এম এ পাশ মাওলানা রইচউদ্দিন

শিক্ষা জীবন: মিয়াজান মল্লিক তাঁর বড় ছেলে মোহাম্মদ আবিদ আলীকে প্রথমে গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি করান। পাঠশালার হেডপণ্ডিত শশী ভূষণ দাস মেধাবী আবিদ আলীকে বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ দেন। বৃত্তি পরীক্ষায় আবিদ আলী জেলার সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রথম হয়ে মাসিক দুই টাকা বৃত্তি লাভ করেন এবং স্কুলে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পান। এম. আকবর আলী এবং তাঁর ছোট ভাই মোহাম্মদ আবদুল জব্বারকেও হেডপণ্ডিত পাঠশালায় বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ দেন।

তিনি পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। পরে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়ন শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন। ১৯৩৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন।

কর্মজীবন: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করার পর সরকারের আয়কর বিভাগে নিরীক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। খুলনা ও চট্টগ্রামে কয়েক বছর কর্মরত থেকে ১৯৪২ সালে কলকাতা অফিসে বদলি হয়ে আসেন। এ সময় থেকেই কলকাতায় শুরু হয় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। ফলে ১৯৪৭ সালে তিনি ঢাকা চলে আসেন। পাকিস্তান পুল সার্ভিসের ক্যাডার তালিকায় ৩০ জনের মধ্যে আকবর আলী ছিলেন একমাত্র বাঙালি। এ তালিকা থেকে ১৯৫৪ সালে করাচিতে তিনি যুগ্ম আয়কর কমিশনার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন এবং পরবর্তী সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি ও পরে উপ-সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান।

আরও পড়ুন লোকসাহিত্য বিশারদ ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন

প্রকাশনা: বাংলা ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান-সভ্যতার প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাথে আধুনিকতার যোগসূত্র স্থাপনকারী প্রথম ও প্রধানতম ব্যক্তিত্ব হলেন এম. আকবর আলী।

সপ্তম থেকে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত বুদ্ধিবৃত্তিক দুনিয়ার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আরবরা। বিজ্ঞান, সাহিত্য, কলা, স্থাপত্য, গণিত, মহাকাশ বিদ্যাসহ জ্ঞানের সকল শাখায় ছিল তাদের অবাধ বিচরণ।

বিশ্বখ্যাত দার্শনিক মানবেন্দ্র নাথ রায় লিখেছেন,

“মুসলমানদের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করেই ইউরোপ আধুনিক বিশ্বের অধিনায়ক হয়ে রইল। এমনকি আজও তার শ্রেষ্ঠ মনীষীরা অতীত ঋণের বাঝা স্বীকার করতে সঙ্কুচিত হন না। দুর্ভাগ্য আমাদের উত্তারিধকার সূত্রে প্রাপ্ত ইসলামের সংস্কৃতি সম্পদ থেকে ভারতবর্ষ তেমন উপকৃত হতে পারেনি। কেননা অনুরূপ সম্মানের অধিকারী হবার যোগ্যতা তার ছিল না। এখনও এই বিলম্বিত রেনেসাঁর সৃষ্টি বেদনায় মানবেতিহাসের এই অবিস্মরণীয় অধ্যায় থেকে প্রেরণা সংগ্রহ করে হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে ভারতবাসীরা প্রভূত লাভবান হতে পারে। মানব সংস্কৃতিতে ইসলামের দান সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ আর উক্ত দানের ঐতিহাসিক মূল্যের যথার্থ অনুধাবন তাদের উদ্ধত আত্মপ্রসাদের প্রাসাদ থেকে বাইরে টেনে নিয়ে এসে হিন্দুদের চকিত বিস্ময়ে অভিভূত করে দেবে আর আমাদের এ যুগের মুসলমানদের সঙ্কীর্ণতা মুক্ত করে তারা যে ধর্মে বিশ্বাসী, তার মর্মবাণীর সঙ্গে তাদের মুখোমুখি পরিচয় করিয়ে দেবে।” (মানবেন্দ্রনাথ রায়, ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান, পৃষ্ঠা ৮৮)।

আরও পড়ুন বাংলাদেশের বইমেলার প্রবর্তক সরদার জয়েনউদ্দীন

ছাত্রজীবন থেকেই আকবর আলী প্রবাসী, মোহাম্মদী, সওগাত এবং আজাদ সহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লিখতেন।

  • সর্বপ্রথম বই ‘চাঁদ মামার দেশ’। ১৯৩৬ সালে প্রকাশ হয় ।
  • ‘বিজ্ঞানে মুসলমানের দান’ তাঁর  সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা। ১২ খণ্ডের প্রায় ৭ হাজার পৃষ্ঠার বইটিতে রয়েছে তিন খণ্ড গণিতশাস্ত্র, দুই খণ্ড রসায়নশাস্ত্র, চার খণ্ড চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং তিন খণ্ড ভূগোল। দুর্ভাগ্য এ জাতির, বইটি এখন আর পাওয়া যায় না।
  • Science in the Quran (3 vols)
  • Aspect of Science in Religions: A Comparative Study (3 vols)
  • জাবির ইবনে হাইয়ান
  • আলবেরুনি
  • ইবনে সিনা
  • ওমর খৈয়াম
  • ইস্তাম্বুলের পথে পথে
  • ভবিষ্যতের বিজ্ঞান ইত্যাদি।

দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর সহযোগিতায় তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা হলো,

  • Scientific Indication in the Holy Quran
  • Muslim Contribution to Science
  • ইবনে হাওকালের ভূগোল, এটি তাঁরএকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদকর্ম।

অবদান: এম. আকবর আলী বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও সাতবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।

মৃত্যু: একনিষ্ঠ গবেষক এম. আকবর আলী ২০০১ সালে ১৮ জানুয়ারি, ঢাকায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৯১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী আলতাব হোসেন, সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুন পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!